দুর্গাপুজো চলাকালীন বাংলাদেশে কোরান অবমাননা ও হিন্দুমূর্তি ভাঙাকে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়িয়েছিল, তারই পাল্টা আঁচ এসে পড়েছিল ত্রিপুরায়। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের বদলা নিতে, ত্রিপুরায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর আক্রমণের একাধিক খবর ছড়িয়ে পড়ে। এদিন সংসদের অধিবেশনে ত্রিপুরার অশান্তি প্রসঙ্গ ওঠামাত্রই কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার সমস্তরকম ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই নিয়েছে’। তার মানে, কেন্দ্রের তরফে একরকম স্বীকার করেই নেওয়া হল — ত্রিপুরায় অশান্তি ছড়ানোর ঘটনা অনেকাংশেই সত্য, এটা কোনও গুজব নয়! এখানেই আরো একটা প্রশ্ন উঠছে, বাস্তবে ঠিক কতটা অশান্তি ছড়িয়েছিল ত্রিপুরায়?

উল্লেখ্য, সেই সময়ে ত্রিপুরার গোমতী জেলাস্থিত মসজিদে ভাঙচুর এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস ও আগুন জ্বালানোর অভিযোগ ছড়িয়েছিল যার কিছুটা সংবাদ মাধ্যমে আসে আর এছাড়াও যে যার মতো করে আলোচনা করতে থাকেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।
এদিন সংসদে সেই প্রশ্ন তোলা হলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে নিত্যানন্দ রাই বলেছেন, “সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে গুজব ও ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানোর জন্য কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা যায়নি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ পোস্টের ক্ষেত্রে ৬ টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে।”
এখানে ‘সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ’ শব্দবন্ধটির দুরকম মানে হয়। এখানে কাদের কথা বলা হচ্ছে? বিপরীত একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা একটু পরিস্কার হতে পারে। সেই অশান্ত সময়ে সাংবাদিক শ্যাম মীরা সিং তাঁর ট্যুইটে লিখেছিলেন, ‘Tripura is burning’. ত্রিপুরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে সাম্প্রদায়িক হিংসার বার্তা ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। দুই আইনজীবি সহ ১০২ টি ট্যুইটার হ্যান্ডেলকে চিহ্নিত করে ইউএপিএ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছিল — যাঁরা সোশ্যাল মাধ্যমে ত্রিপুরার সংখ্যালঘু অত্যাচারের বিপক্ষে কথা বলেছিলেন। গত মাসেই ত্রিপুরায় সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া দুই মহিলা সাংবাদিককে ওই একই আইনে গ্রেপ্তার ও নজরবন্দী করা হয়। এই ঘটনাগুলি তাহলে কোনদিকে ইঙ্গিত করছে? প্রশ্নের সদুত্তর মিলছেনা।

সংসদে নিত্যানন্দ রাই আরো বলেন, “এই ধরনের ঘটনা রোধ করতে ত্রিপুরা সরকার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ব্যাপকভাবে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করেছে।” প্রশ্ন হল, কোন ধরনের ঘটনার কথা বলা হচ্ছে এবং কেনই বা ব্যাপক পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করতে হলো? যেখানে ত্রিপুরার অশান্তির ঘটনাকে ‘গুজব’ আখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে ত্রিপুরায় নাকি কোনও বড় ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেইনি!

নিত্যানন্দ রাইয়ের বক্তব্য, “ত্রিপুরা সরকার জানিয়েছে সম্পত্তি ক্ষতির কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে।” প্রশ্ন উঠছে ‘বিক্ষিপ্ত ঘটনা’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন? উল্লেখ্য, ত্রিপুরায় অশান্তি চলাকালীন যেমন কিছু অগ্নিগর্ভ পুরোনো ছবি সম্বলিত ভূয়ো পোস্ট ছড়িয়েছে , তেমনই গেরুয়া পোশাকধারী একদঙ্গল লোকের হিংসায় উন্মত্ত উল্লাস এবং তান্ডব লীলার বেশকিছু ছবি ও ভিডিও ক্লিপ সেসময় সোশ্যাল মিডিয়ায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে অনেকের দাবি, তার ফলেই কি ত্রিপুরা রাজ্য সরকার অমন ক্ষিপ্ত হয়ে রাতারাতি সংবাদ সংগ্রাহক, আলোচক ও আইনজীবিদের ধরপাকড়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন? এই দুধরনের ঘটনাকে একাকার করে প্রকৃত সংবাদ সংগ্রাহকদের আটকানো কেন?
প্রসঙ্গত, চলতি সপ্তাহেই সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ‘ইউএপিএ'(Unlawful Activity Prevention Act) ধারার যথেচ্ছ প্রয়োগ নিয়ে সওয়াল তুলে কেন্দ্র সরকার ও ত্রিপুরা রাজ্য সরকারকে নোটিশ ধরিয়েছেন।

যদি মেনে নেওয়াও যায়, কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী — বিক্ষিপ্ত অশান্তি যা কিনা কারোর দ্বারাই নিরূপণ যোগ্য নয়, অতএব কে কাকে ধরে! যদি মেনে নেওয়া যায়, এছাড়া আর কিছু ঘটেনি; মসজিদ ভাঙচুর বা ধর্ষণ ঘটেনি, প্রশ্ন হল তাহলে সংবাদ সংগ্রাহক, আইনজীবি ও মানবাধিকারের পক্ষে আলোচনাকারীদের কন্ঠরোধের প্রয়োজন হয় কেন?
সোশ্যাল মিডিয়া! ছেড়ে দেওয়া হল, ধরে নেওয়া হল সেসব ফালতু কথা। এবার প্রশ্ন উঠল, আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবার কিছু প্রশ্ন রেখেছেন তার উত্তর কী হবে?