এই মূহুর্তে সারা বিশ্বব্যাপি ব্যবহারিক অ্যাপগুলোর মধ্যে শীর্ষ স্থানে রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২ বিলিয়ন ইউজার এই অ্যাপ ব্যবহার করছেন। হোয়াটসঅ্যাপের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট উইল কাথকার্ট জানিয়েছেন প্রতি মাসে ১০০ বিলিয়ন মেসেজ এই মাধ্যমে আদানপ্রদান করা হয়।
সাধারণত মাথা না ঘামালেও একটা প্রশ্ন একটু খেয়াল করলেই বড় জিজ্ঞাসা চিহ্ন নিয়ে দেখা দিতে পারে — হোয়াটসঅ্যাপের আয়ের উৎস কী?
সকলেরই জানা, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো সাবস্ক্রিপশন ফি নেই, নেই কোনো থার্ড পার্টি অ্যাপের সাথে যোগাযোগ (যেমন ফেসবুকের ক্ষেত্রে ম্যাসেঞ্জার), এমনকি কোনোরকম বিজ্ঞাপনও নয়। তাহলে এত এসএমএস, ভিডিও কলিং থেকে যাবতীয় ব্যবহার সম্পূর্ণটাই কি বিনামূল্যে হয়! তাতে হোয়াটসঅ্যাপের লাভ কী?
২০০৯ সালে ব্রায়ান অ্যকশান ও জন কৌম যৌথভাবে অ্যাপটি তৈরি করেন।তখন যদিও এটি ফ্রি অ্যাপ ছিলনা। বছরে ৯৯ সেন্ট করে সাবস্ক্রিপশন চার্জ দিতে হত ব্যবহারকারীদের। পরবর্তী বছরেই হোয়াটসঅ্যাপ অ্যান্ড্রয়েড ভার্সন আনায় তা আরও অধিক জনপ্রিয় হয়। এরপর ২০১২ সালে মাসিক ইউজার সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০ মিলিয়ন, ২০১৩ সালে একলাফে তা ৪০০ মিলিয়ন ছাপিয়ে যায়। ধীরে ধীরে হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষ সাবস্ক্রিপশন ব্যাপারটাই তুলে দেয়, সম্পূর্ণ ফ্রিতে ব্যবহার্য অ্যাপ হিসেবে।
ঠিক তার পরের বছরেই ফেসবুক সংস্থা হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নেয়।
তাহলে প্রশ্ন, কিনে নেওয়া সত্ত্বেও বিনামূল্যে সবাই হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে যাচ্ছেন, তাতে তো ফেসবুকেরও লোকশান? না একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে একেবারেই লোকশান নয়।
হোয়াটসঅ্যাপকে কেনার পেছনে ফেসবুকের আসল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিযোগীকে নিজের আওয়ায় এনে ফেলা। ব্যবহারিক জনপ্রিয়তায় হোয়াটসঅ্যাপ টেক্কা দিয়েছিল ম্যাসেঞ্জারকেও। তাই ফেসবুকের এমন সিদ্ধান্ত। যাতে প্রতিযোগী না হয়ে হোয়াটসঅ্যাপ তাদের সহায়ক হয়ে ওঠে। সে নাহয় হলো, কিন্তু বিজনেস – প্রফিট, তার উৎস কী?
ফেসবুকের ব্যবসার এই প্রক্রিয়ার নেপথ্যে একটা মন্ত্র আছে, সেটি হল “If you’re not paying for the product, you are the product “. আপনিই প্রোডাক্ট। আপনি মানে আপনার ডাটা। ভেবে দেখলে এই দুটো তো অবিচ্ছিন্ন নয়!
হোয়াটসঅ্যাপে সংরক্ষিত আপনার ডাটা যা আপনি তাকে নিজেই দিয়েছেন সেটাই ফেসবুক কর্তৃক সংগৃহীত হয়। আপনি চাইলেও সেগুলি না দিয়ে পারবেননা, কারণ হোয়াটসঅ্যাপের পলিসিতেই সেটির উল্লেখ আছে। তাকে অনুমতি দিয়েই আপনি অ্যাপ ব্যবহার করতে পারছেন, নাহলে নয়।
এবার শুরু হয় ডাটা অ্যানালিসিস প্রক্রিয়া। বিহেভিয়ারাল ডাটা– মানে আপনি কী পছন্দ করেন, না করেন (যা প্রতিদিনই হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে জেনে বা অজান্তে রেখে থাকেন), ব্যক্তিগত ইনফর্মেশন, কন্ট্যাক্ট লিস্ট এবং লোকেশান ডাটা — এই চারটি সংগ্রহ করলেই আপনি হয়ে যান ‘টার্গেটেড অডিয়েন্স’। এবার আপনি ঠিক যা চান সেই অনুযায়ী বিজ্ঞাপন আপনারই চোখের সামনে আসতে থাকে।
এক বাক্যে বলতে গেলে হোয়াটসঅ্যাপ হল ফেসবুকেরই ডাটা কালেক্টর। অনেক আগে থেকেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে ব্যবহারকারীদের পার্সোনাল ডাাটা বিক্রী করার অভিযোগ ছিল, এবং সেই ইস্যুতে কয়েকটি মামলাও করা হয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপ তারই একটি অন্যতম সংযোজন। যা ফেসবুককে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কন্ট্যাক্ট নাম্বার ও লোকেশন সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানিকে নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন দেখাতে সহায়তা করে।
হোয়াটসঅ্যাপের আয়ের পরিমাণ কত সেটা সঠিকভাবে বলা হয়তো সম্ভব নয়, কারণ কর্তৃপক্ষ তা বাইরে প্রকাশ হতে দেয়না। তবু আনুমানিক উদাহরণ হিসেবে Forbes এর দেওয়া রিপোর্টের একটি তথ্য রাখা যেতে পারে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী ফেসবুক মনিটরিং এর মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপ ৫ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। এছাড়াও পরবর্তীকালে হোয়াটসঅ্যাপ নিয়ে এসেছে বিজনেস অ্যাকাউন্ট। যাতে করে বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া আরও সহজ হয়েছে। এখানেও ডাটা অ্যানালিসিস তো বটেই, তাছাড়াও নির্ধারিত সময়সীমার পর সাবস্ক্রিপশন চার্জও নেওয়া হয়ে থাকে।
যদিও বলা হয় হোয়াটসঅ্যাপে ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন ‘ থাকায় হোয়াটসঅ্যাপের পক্ষে ডাটা সংগ্রহ সম্ভব নয়। কিন্তু সত্যিই তারা কোন প্রযুক্তি এক্ষেত্রে ব্যবহার করে সেটাও সাধারণ লোকের অজানা। সেটা যদি ঠিকও হয়, শুধুমাত্র কন্ট্যাক্ট লিস্ট আর লোকেশান তথ্যই যদি ফেসবুক তার মাধ্যমে পায় সেটাই বা কম কী?