বিজেপিতে পুরাতনীদের সাথে নতুন গোষ্ঠীর সংঘাত রাজনীতিতে অজানা নয়, তবে ইদানিং দেখা যাচ্ছে দলের অভ্যন্তরে কাজ করছে অন্য এক সমীকরণ। এই সমীকরণ হল — বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। যার প্রসঙ্গে কথা উঠলে পুরাতনী তথাগত রায় এবং নব্যতম সুকান্ত মজুমদার দুজনেই দন্ডবৎ এক পায়ে খাড়া; যাকে দলের কাছে একটু আলাদাই গুরুত্ব সহকারে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয়েছে; যিনি এইমূহুর্তে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্ষমতাসীন — তিনি শুভেন্দু অধিকারী। বিজেপি শিবিরের একাংশ তাই মনে করছেন।
সম্প্রতি দলের দীর্ঘদিনের সদস্য হাওড়া সদরের বিজেপি সভাপতি সুরজিৎ সাহাকে দল থেকে বহিষ্কার করা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গেরুয়া শিবিরের অভ্যন্তরে। সুকান্ত মজুমদারের তাৎক্ষণিক ওই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেননা অনেকেই। তাঁদের প্রশ্ন, ‘শুভেন্দু অধিকারীর বিরোধীতা করা মানেই কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ?’
দলের রাজ্যসভাপতি সুকান্ত মজুমদার অবশ্য সুরজিৎ সাহার বহিস্কারকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন। তাঁর মতে দলের অভ্যন্তরীণ আলোচনার বিষয়কে সুরজিৎ জনসমক্ষে এনে ফেলেছেন, সুতরাং এটা বিশৃঙ্খলা বলে মনে করা হয়েছে।
দলের নেতৃত্ব মনে করেছেন এটাই অকাট্য যুক্তি। কিন্তু পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বিজেপি শিবিরের একাংশ প্রশ্ন রেখেছেন — সুরজিৎ সাহাকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হলনা কেন? জানতে চাওয়া হলনা কেন তাঁর আচরণ সম্পর্কে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণ? একেবারে সরাসরি বহিস্কার!
দ্বিতীয়ত, দলের এক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সমালোচনা যদি বিশৃঙ্খলাই হয়, তাহলে সেই বিশৃঙ্খল আচরণ তো প্রবীণ নেতা তথাগত রায় প্রত্যেকদিনই ট্যুইটার মারফত করে চলেছেন। যেভাবে তিনি প্রকাশ্য মাধ্যমে ‘কেডিএসএ’ অর্থাৎ কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, দিলীপ ঘোষ, শিবপ্রকাশ ও অরবিন্দ — চার নেতৃত্বের মানসম্ভ্রম নামিয়ে এনে করে চলেছেন, তাঁকে দল বহিস্কার করছেনা কেন?
এখানেও সুকান্ত মজুমদার একটা যুক্তি তৈরি করে বলেছেন, “আমরা তথাগত রায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারিনা। ওটা কেন্দ্রের বিষয়। “। সুকান্তর এই যুক্তিকে হজম করতে পারছেননা বিজেপি শিবিরের একাংশ। কারণ, ২৮ বছর ধরে দলের সাথে ওতপ্রোত জড়িত এবং জেলা সভাপতির পদাধিকারী সুরজিৎ সাহাকে যদি এককথায় বহিস্কার করা যায়, তাহলে একজন সাধারণ সদস্য হয়ে ওই একই আচরণ দিনের পর দিন করে তথাগত রায় নিস্তার পান, এটা কীকরে সম্ভব?
আর এখানেই বিজেপির রাজ্য রাজনীতিতে অন্যরকম সমীকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতার ব্যক্তিকরণই কি পরোক্ষভাবে কাজ করছে এখানে? কারণ দুয়ে দুয়ে চার করলে যা দাঁড়ায়, একটু মনোযোগ দিলেই সেটা বোঝা যাবে।
দেখা যাচ্ছে, শুভেন্দু অধিকারী তথাগত রায়ের প্রিয়তম নেতাদের একজন। এই তথাগত রায়ই শুভেন্দু অধিকারীকে ক্লিনচিট দিয়ে “সম্ভাবনাময় লড়াকু নেতা” বলে ভূষিত করেছিলেন। শুভেন্দুকেও দেখা গেছে তথাগত রায়ের আশীর্বাদ ধন্য হতে। এছাড়াও নব্য রাজ্যসভাপতির সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে দেখা গেছে শুভেন্দু, তথাগত, সুকান্ত তিনমূর্তি পাশাপাশি আসনে বসেছেন। কার্যত সেদিনের ওই অনুষ্ঠানে এবং অনুষ্ঠানের পরেও তথাগতর প্রিয় মাধ্যম ট্যুইটারে দিলীপ ঘোষকে ন্যক্কারজনক ভাবে অপমান করে সুকান্ত মজুমদারকে “শিক্ষিত, প্রগতিশীল ” ইত্যাদি সম্ভাষণে ভরিয়ে তুলেছেন।
তাহলে এই সমীকরণই কি বিজেপির রাজ্য মানচিত্রে কাজ করছে আড়ালে। যে কারণেই তথাগতর বেলা সাত গালাগালিও মাফ, আর দলের ২৮ বছরের সদস্যকে শুভেন্দুর বিরোধিতার জন্য এক তুড়িতে বহিস্কার! দল নয়, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি শিবিরে শুভেন্দু অধিকারীই কি তাহলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছেন? গেরুয়া শিবিরের একাংশ জোরালোভাবে এই প্রশ্নগুলোই তুলছেন।