সিকির যেমন দুটো পিঠ থাকে তেমনই প্রতিটি ঘটনা বা বস্তুরই দুটো বিপরীত দিক থাকা অনিবার্য। কথাটা উঠল সাম্প্রতিক ভাইরাল নম্বর ১১৭৬ নিয়ে। নেটনাগরিক থেকে তাত্ত্বিকগণ, বিশ্বাসী থেকে অবিশ্বাসী প্রত্যেকেই নাম্বারটির বিশেষত্ব নিয়ে ভাবছেন ঠিকই, তবে তাঁরা সবাই একটা পিঠ লক্ষ্য করছেন। অনেকের দাবি এটি একটি ‘অ্যাঞ্জেল নাম্বার’–অর্থাৎ ‘আর্চ’ ও ‘গারডিয়ান’ পরী বা দৈবী ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ম্যাজিকাল নাম্বার, যা আপনার মনোবাসনা পূরণ করবে।
এখন যদি বলি, হ্যাঁ অবশ্যই ১১৭৬ নাম্বারটি প্রাসঙ্গিক। তবে সবাই যা ভাবছেন, তেমনভাবে নয়! একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য আপনাদের চোখের সামনেই রয়েছে, যা আপনারা দেখেও দেখছেন না! বেশ, তাহলে আলোচনার শেষেই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে।
কীভাবে ছড়ালো এই নাম্বার! ব্যাপারটা আকস্মিকভাবেই ঘটে। জনৈক নেটিজেন রটিয়ে দেন,’১১৭৬ হরে কৃষ্ণ’ লিখলেই আপনার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে এটি ভাইরাল হয়ে যায়। ফেসবুক, ট্যুইটার সহ প্রতিটি সোশ্যাল মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই বাক্যবন্ধ, রীতিমতো সাড়া পড়ে গেছে নেটদুনিয়ায়।
এমনকি বহু তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরাও এবিষয়ে নিজেদের মতামত রাখছেন। বিশেষত আলোচনা হচ্ছে ১১৭৬ নাম্বারটি নিয়ে। কেননা, দেবদেবীর নাম অথবা ছবি দিয়ে মনোবাঞ্ছা পূরণ করার ট্রেন্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই প্রচলিত। সকলের মনে তাই ছাপ ফেলেছে ওই বিশেষ নাম্বার ১১৭৬!
কিন্তু এই নাম্বারটিকেই বেছে নেওয়া হল কেন? অন্য কিছুও তো হতে পারত! এই সংশয় থেকেই জন্মাচ্ছে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস। নেটিজেনদের বিভিন্ন মত। কেউ বলছেন লিখে সাথে সাথেই ফল পেয়েছেন, কারুর মতে বিশ্বাস নাই বা করলাম লিখতে ক্ষতি কী! আবার অনেকে বলছেন, লিখেছেন ,এখনও ইচ্ছেপূরণ হয়নি তবে অপেক্ষায় আছেন। এবার একনজরে দেখা যাক বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন।
বিশিষ্ট পুরাণ গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বলছেন, “আমি কখনোই শাস্ত্র ঘেঁটে এই ধরণের নাম্বারের উল্লেখ পাইনি। এই ধরনের নাম্বার লিখে সৌভাগ্য পাওয়ার চেষ্টা নিতান্তই বোকামি। আমার অন্তত এ নিয়ে কিছু জানা নেই।”
পাশাপাশি মায়াপুরের ইস্কনের পক্ষ থেকে জগদার্হিতা দাসের মতে, “আমাদের চেনাজানা শাস্ত্র এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে ‘হরেকৃষ্ণ’ হল মহামন্ত্র। কিন্তু এমন কোনও সংখ্যার উল্লেখ কোথাও পাইনি।” সাধক বিশেষে ২৫ হাজারবার অথবা ৩ লক্ষবার মালা জপ করার ধারা চালু থাকলেও বিশেষ কোনও সংখ্যার কথা বৈষ্ণব শাস্ত্রে বলা হয়নি, জানিয়েছেন তিনি।
এককথায় প্রায় কেউই এই নাম্বারটির প্রামাণ্য উল্লেখ কোথাও পাননি বলেই জানিয়েছেন। অথচ মনোবাসনা পূরণকারী ‘অ্যাঞ্জেল নাম্বার’ হিসেবে ১১৭৬ জনমানসে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। এবার একটি তথ্য আপনাদের সামনে রাখতে চাই, যা আপনারাও হয়তো জানেন, কিন্তু ভুলে গেছেন।
বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, বৈষ্ণব শাস্ত্র কোথ্থাও এই নাম্বারের উল্লেখ না থাকলেও ইতিহাসের পাতায় এর উল্লেখ একেবারে জ্বলজ্বল করছে! যা স্মরণ করলে ১১৭৬ সংখ্যাকে ‘অ্যাঞ্জেল’ নয় ‘ডেভিল নাম্বার'(শয়তান) মনে হতে শুরু হবে।
১১৭৬ সালটি ‘ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়, ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষের কাল, মহামারীর কাল — ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। দ্বৈত শাসনব্যবস্থার ফলে অমানবিক শোষণ, যাকে পার্সিভাল স্পিয়ার ‘প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ লুন্ঠনের যুগ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। অতিরিক্ত কর আদায়, তার ওপর ২ বছর অনাবৃষ্টিতে বাংলা ও বিহারের কৃষিকার্যের ব্যাপক ক্ষতি, জল ও খাদ্য না পেয়ে আবর্জনা খুঁটে খেয়ে অসুস্থ হয়ে গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়া ভয়াবহ সেই ছবি! ১১৭৬ বঙ্গাব্দে যা মহামারীর আকার ধারণ করেছিল। মনে পড়েছে?
এ নেহাতই কাকতালীয়, তবু আজকের এই সময়ে খানিক প্রাসঙ্গিতা আছে বৈকি! এবার আপনি ভাবুন, সমগ্র পৃথিবীর আরো এক ভয়ানক সংকটের পর্যায়ে দাঁড়িয়ে ১১৭৬-কে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবেন!