অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সম্প্রতি এমন এক মন্তব্য করেছেন যা ইতিহাস সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। মুঘল তো বটেই, নিজাম -দেরও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন তিনি।
তেলেঙ্গানার ওয়ারাঙ্গালের এক বৈঠকে অসমের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ইতিমধ্যেই ৩৭০ ধারাকে মুছে ফেলা হয়েছে , ওদিকে রামমন্দির নির্মাণের কাজও শুরু হয়ে গেছে। সেদিন আর খুব দূরে নেই হায়দরাবাদ থেকে নিজামের নাম, ওয়াইসির নাম এবার বাদ হয়ে যাব। ইতিহাস সাক্ষী আছে বাবর , ঔরঙ্গজেব , নিজামরা ভারতে বেশিদিন টেঁকেনি।”
ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে গিয়ে বিজেপি নেতারা বারংবার ঔরঙ্গজেব , মুঘলদের আক্রমণের একটি ধারা বেছে নিয়েছেন। তাঁরা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, ভারতের ইতিহাস আলোচনা করার সময় ব্রিটিশদের মতোই পূর্ববর্তী পাল রাজা, সেন রাজার মতো ‘মুঘল সম্রাটদের’ কথাও উঠে আসবে। আর এখানেই বিতর্কটা তৈরি হচ্ছে ইতিহাসবিদদের সাথে। হায়দরাবাদের নিজামদের মুছে ফেলার প্রসঙ্গে যে বিতর্ক আরো উস্কে দিলেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। ইতিহাসবিদদের প্রশ্ন, হিমন্ত বিশ্বশর্মা ইতিহাস মোছবার কে?
মুছে ফেলবার কথা বলতে বিজেপি নেতা ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন? মুঘল আমলে হুমায়ুনের ‘মানমন্দির’ নির্মাণকে মুছতে পারবেন? যা কিনা জোতির্বিজ্ঞানের উন্নতির নিদর্শন! ফতেপুর সিক্রি, তাজমহলকে মুছে দিতে পারবেন? শেখ দীন মহম্মদকে মুছে ফেলবেন, সেই সময়েই যিনি শ্যাম্পু তৈরির প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন! বিজেপি নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রীর জানা উচিত, বাবর শুধুমাত্র একজন শাসক ছিলেননা , একইসাথে তিনি ছিলেন কবি ও শিল্পী। কাশ্মীরকে তিনি ভালোবেসে ‘ব্যক্তিগত বাগিচা’ বলে উল্লেখ করতেন। ঐতিহাসিক হরবংশ মুখিয়া বলেছেন, “সংস্কৃতি ও সেনা পরিচালনার ক্ষেত্রে বাবর নিঃসন্দেহে অনন্য ব্যক্তিত্ব , যদি বাবর ভারতে না আসতেন তাহলে ভারতের সংস্কৃতি হয়তো এতটা বিচিত্র হবার সুযোগ পেতনা।” মুছে ফেলবেন নাকি এসব?
নিজামদের গ্যারান্টেড স্টেট রেলওয়ে, ডেকান সিগারেট কারখানা, সুগার ফ্যাক্টরি নির্মাণ — মুছবেন কীকরে? আর কেনই বা মুছে ফেলার কথা বলছেন বিজেপি নেতারা? তাঁরা কি ইতিহাসের রচয়িতা নাকি , যে বারংবার ইতিহাস নিয়ে টানাটানি করছেন?
ঠিক এই প্রশ্নই রেখেছেন টিআরএস বিধায়ক ও তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কলভাকুন্তলা।
তিনি সামাজিক মাধ্যমে লিখে জানিয়েছেন, “বিজেপি যে তেলেঙ্গানার গৌরবময় ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছে, তা আজ আপনার (হিমন্ত) কথায় স্পষ্ট বোঝা গেল। আপনার দল বিজেপি ঐক্যের ভাবনাকে এতটা ভয় পায় কেন?”
ইতিহাস তার নিজের গতিপথ তৈরি করে নেয়। এই পথনির্দেশে যদি ‘হিন্দু সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণে বিজেপির ভূমিকা’ চিহ্নিত হয়, তবে তা আপনা থেকেই হবে। কিন্তু এইভাবে বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের প্রতি আক্রোশবশত ইতিহাস থেকে যদি তাদের মুছে ফেলার কথা বলা হয়, তাহলে ইতিহাসের পড়ুয়ারা কী পড়বেন? ‘মোদী চরিতাভিধান’, আর যোগী আদিত্যনাথ, হিমন্ত বিশ্বশর্মার জীবনী? ইতিহাসবিদরা সেই প্রশ্নই রেখেছেন।