ইতিহাসে বর্ণিত অনেক তথ্যই গবেষণাসাপেক্ষ। তাই বলে মনমর্জি অনুযায়ী নিজেদের ইচ্ছায় কোনও একটি মতকেই ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া এবং এটাই সঠিক বলে জোরের সাথে দাবি করা যায় কি? বাংলার নববর্ষ চালু নিয়ে গোড়া থেকেই একটা বিতর্ক রয়েছে গবেষকদের মধ্যে। সেই অনুযায়ী দুটি মতও পপাশাপাশি রয়েছে। রাজা শশাঙ্ক নাকি সম্রাট আকবর! নববর্ষ সূচনায় কার অবদান? এই তর্কে স্বভাবতই ‘ইসলাম বিরোধী’-রা আকবরের নামটি কেটে রাজা শশাঙ্কের নাম বসানোর দাবি তুলেছেন। বাংলা নববর্ষের সূচনায় এই দাবিকে সামনে রেখেই জোর প্রচারে নামছে সঙ্ঘ পরিবার।
এই বিশেষ কর্মসূচির জন্য সঙ্ঘের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ‘বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ’ নামের এই সংগঠন কলকাতায় বিভিন্ন প্রদর্শনী, সেমিনার ইত্যাদি আয়োজন করবে, ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে বিভিন্ন এলাকায় চলবে জনমত তৈরির কাজ। উদ্দেশ্য একটাই –বাংলা নববর্ষের পেছনে রাজা শশাঙ্কের কীর্তি প্রচার। এই পরিষদের সম্পাদক প্রবীর ভট্টাচার্যের মতে, “ভারতে ইতিহাস বিকৃতির অনেক চেষ্টা হয়েছে। বঙ্গাব্দ নিয়েও তাই। বাঙালির নিজস্ব কীর্তি ও কৃতিত্বও মোগলদের বলে দাবি করা হয়। এটা ঐতিহাসিকভাবে অসত্য।”
তাই সঙ্ঘ পরিবার ইতিহাস সংশোধনের দায়িত্ব নিয়ে এবারের নববর্ষে রাস্তায় নামছেন। কিন্তু হঠাৎ বঙ্গাব্দ নিয়ে সঙ্ঘের এই মাথাব্যথা কেন? প্রশ্ন উঠেছে। এটা কি বাঙালিদের মন জয়ের উদ্দেশ্যে? উত্তরে সঙ্ঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “আালাদা করে বাঙালির মন জয়ের উদ্দেশ্যে নয়, বাংলার ঐতিহ্য সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করাই মূল কারণ।” বেশ, ভালো উদ্যোগ। তবে ইতিহাস তো নদীর মতোই বহমান তাই নিচের কথাগুলিও মাথায় রাখা দরকার।
সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্কই বাংলা নববর্ষের উদ্ভাবক — কিছু গবেষক এমনটা মনে করলেও অন্যান্য নথিপত্র এটাও দেখায় –কৃষিভিত্তিক বাংলায় কর আদায়ের উদ্দেশ্যে নববর্ষের প্রসার ঘটান সম্রাট আকবর। বাংলাদেশের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক শামসুজ্জামান যেই দিনটিকে ‘ভূমিরাজস্ব আদায়ের উৎসবের দিন’ বলে আখ্যায়িত করেন। সারাবছরের বকেয়া খাজনা এদিন জমা করা হত এবং উৎসব পালনের মধ্যে দিয়ে পরবর্তী বছরের সূচনা হত। কালক্রমে এই পদ্ধতিই ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ‘হালখাতা’-য় রূপান্তরিত হয়।
পাশাপাশি ঐতিহাসিক নীতিশ সেনগুপ্ত দেখান, ‘বাংলায় সাল বা সন কথটা প্রচলিত। দুটিই আরবী ও ফারসী শব্দ।’ এখান থেকেই বোঝা যায় কোনও সুলতানের দ্বারাই এই বর্ষপঞ্জি সূচিত হয়েছিল। যদি ঐতিহাসিক নীতীশ সেনগুপ্ত এটাও বলেছেন, ‘বঙ্গাব্দ শব্দটি প্রাচীন।’ বাংলা নববর্ষ ও দিনপঞ্জি বা পঞ্জিকার বিবর্তন বহুদিন ধরে ধাপে ধাপে এসেছে। সুতরাং সমস্ত কীর্তিটাই রাজা শশাঙ্কের ওপর আরোপিত করে সম্রাট আকবর বা মোঘল সুলতানের নাম ছেঁটে দেওয়াই কি ইতিহাসের বিকৃতি নয়! ঐতিহাসিকরাই এর সঠিক বিচার করতে পারেন।