বিতর্ক আজ নতুন নয়। বিগত কয়েকবছরে বেশ কয়েকবার রামনবমীতে বিজেপি কর্মীদের অস্ত্রহাতে মিছিল করতে দেখা গিয়েছে। ২০১৮ সালে লকেট চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ ঘোষের মতো নেতানেত্রীরা অস্ত্র হাতে মিছিল করায় তুমুল সমালোচিত হয়েছিলেন।
এরপরেও অবশ্য দমেনি বিজেপি। যথারীতি এবারেও ত্রিশূল, তলোয়ার, হাঁসুয়া নিয়ে বিপুল সমারোহে বিজেপি নেকাকর্মীদের মিছিল লক্ষ্য করা গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে কেন এই অস্ত্র প্রদর্শন? উত্তরে দিলীপ ঘোষ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে উত্তর দেন, “রামের নামে মিছিল, হাতে অস্ত্র নয় তো কি লাড্ডু থাকবে?”
তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, রামচন্দ্র যোদ্ধা বলেই তাঁর ভক্তদের হাতেও অস্ত্র থাকবে বৈকি! তবে পুরাণবিদরা আদৌ রামচন্দ্রের এই বিশেষ তিথির সাথে অস্ত্রের যোগ খুঁজে পাননি। বরং রামায়ণকে ‘করুণ রসের কাব্য’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। পুরাণ গবেষকরা রামচন্দ্রের মধ্যে কৃপার অবতার ও ভীষণ কোমল প্রকৃতির মানবায়ন দেখত পেয়েছেন।”
‘অস্ত্র সব দেবদেবীর হাতেই থাকে’ বিজেপির এহেন যুক্তি দিয়ে সশস্ত্র হয়ে ‘জয় শ্রীরাম!’ উল্লাস ধ্বনির সাথে রামচন্দ্র বা রামায়ণের আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। এমনটাই তাঁরা মনে করেন।
বিশিষ্ট পুরাণ গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি জানান, “আমাদের দেশে বা বাংলাদেশে কোনওকালেই এই রীতি ছিলনা। যাঁরা রামচন্দ্রকে আশ্রয় করে রাজনীতি করছেন তাঁরাই এগুলি করছেন।” পাশাপাশি নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বলেন, “রামনবমী চৈতন্যদেবের আমলে পালন শুরু হয়। বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে যেসকল অবতারে মনুষ্য লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে তাঁদের প্রচারের উদ্দেশ্যেই নৃসিংহ চতুর্দশী, বামন দ্বাদশী, রাম নবমী ইত্যাদি পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন চৈতন্যদেব।” এই রাম নবমী পালনের সাথে অস্ত্রশস্ত্রের কোনও যোগযোগ ছিলনা।
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি স্পষ্টতই বলেছেন , “যাঁরা নতুন করে রামায়ণ লিখছেন, রামচন্দ্রকে নতুন করে চেনাতে চাইছেন এগুলো তাঁদেরই কীর্তি। ”
তবে বিজেপি নেতারা এসব যুক্তি মানবেনই বা কেন? এক্ষেত্রে দিলীপ ঘোষকে ছাপিয়ে আরও এক লেভেলে পৌঁছে গিয়েছেন বিজেপির রাজ্যকমিটির সদস্য উমেশ রায়। অস্ত্র ধারণের সাপেক্ষে আজব এক তত্ত্ব খাড়া করেছেন।
তাঁর মতে, “সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি যাঁদের শ্রদ্ধা আছে, যারা রামায়ণ পাঠ করেছে, সকলেই জানে, যখন যখন সমাজের উপর সঙ্কট নেমে আসে, অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দেয়, তখন তখনই অস্ত্র তুলে নিতে হয়।” এই কথা তুলে ধরতেই বিজেপি নেতা উমেশ রায় ও দিলীপ ঘোষরা রাম নবমী তিথিতে অস্ত্র তুলে নেন! এটাই নাকি ভারতের সংস্কৃতি ও সভ্যতা!
সম্ভবত শ্রীকৃষ্ণের শ্লোককে রামচন্দ্রের ঘাড়ে(পড়ুন যে রামচন্দ্র সীতাকে হারিয়ে হায় হায় বলে ভেঙে গিয়ে বিলাপ করতে থাকেন) চাপিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়েছেন।
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত/অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানম্ সৃজাম্যহম্/ পরিত্রাণায় সাধুনাম্ বিনাশায়চ দুষ্কৃতাম্/ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে”–এটা শ্রীরামের কল্পনা থেকে শতযোজন দূরে। কারণ এটা দ্বাপরযুগে দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টিভঙ্গি। বেশ, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়াও যায়, ‘ধর্ম সংস্থাপনের উদ্দেশ্যেই’ অস্ত্র তুলে নেওয়া, তাহলেও বড় প্রশ্ন রয়ে যায়। এযুগের ‘সম্ভবামি’ অবতারটি কে? দিলীপ ঘোষ! জে.পি. নাড্ডা! মোহন ভাগবত নাকি নরেন্দ্র মোদী? কে সেই অবতার!