‘পাকস্থলীতে তো ইসলাম নেই, নেইকো হিন্দুয়ানি / তাতে যা জল তাহাই পানি।”
এই লাইনগুলিতে যেমন ধর্মকে জলের মতোই সরল ও আপন করে নেওয়া আছে, তেমনই আছে তার ভেদাভেদ নিয়ে অবসানের সূত্রও। কিন্তু সমাজ এই নিয়মে চলেনা। তাই জলের মধ্যেও বিতর্ক জমাট বাঁধতে থাকে। এই মূহুর্তে অডিও ফাঁস হয়ে গিয়ে যিনি বিতর্কের শিরোনামে, সেই কবীর সুমনকে নিয়ে বলতে গেলে এই কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবেই আসবে।
সেই সুমন, যিনি ‘চট্টোপাধ্যায়’ থেকে ‘কবীর’ হয়ে ইসলামকে আপন করে নিয়েছিলেন।
এক সাক্ষাৎকারে সুমন নিজেই বলেছিলেন, “স্টেজে একের পর এক গান গেয়ে যখন শুনিয়েছি, তখন কেউ আমাকে আঙুল তুলে বলেননি আপনি চট্টোপাধ্যায়, আপনার পদবি বাদ দিয়ে তারপর যা বলবার বলুন; যখন আমি কবীর সুমন তখন আঙুল উঠতে শুরু করল পদবি লক্ষ্য করে!”
ঘটনাচক্রে তাই। কিন্তু কেন মুসলমান হলেন তিনি? ইসলাম নেওয়ার পেছনে ছিল কি নির্দিষ্ট কোনও অভিপ্রায়? এই প্রশ্ন সুমনকে একাধিকবার ফেস করতে হয়েছে। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের প্রখ্যাত গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে করার জন্যই সুমন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কথাটা একাংশে সঠিক হলেও সেটাই একমাত্র কারণ নয়।
সুমনের নিজের বক্তব্য খুঁড়লেই পাওয়া যায়, একটি রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের ওপর নিষ্ঠুর আঘাতের প্রত্যুত্তরেই তিনি ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত। “এমনকি আমি খ্রিস্টান হতেও পারতাম!” সুমনেরই কথা। দু-একটি ঘটনার কথা তিনি বলেছিলেন।
উড়িষ্যার এক খ্রিস্টান ফাদারকে তাঁর দুই নাবালক পুত্র সমেত পুড়িয়ে মেরেছিল হিন্দুরা, এছাড়াও দাঙ্গায় মুসলিমদের মৃত্যু, পুলিশের দ্বারা এক বান্ধবীর ধর্ষিত হওয়া– এইসব ঘটনা প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল সুমনকে। তিনি প্রভু যীশুর কথা উল্লেখ করে বলেন, “একজন শুধুমাত্র শিষ্যদের জন্য হাতে পায়ে পেরেক গুঁজে ঝুলে আছেন! এই ছবির যে নির্মম আবেদন এটা উপেক্ষা করার করতে পারিনা আমি!” তবু মূলত হজরত মহম্মদকে ‘গ্রেট লিডার ও গ্রেট প্রফেট’ মনে করেই তিনি শেষমেশ ইসলাম ধর্মমতকেই বেছে নিয়েছিলেন।
এমনকি নিজের এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “কবীরের নামটি নেওয়া অতীতের এক মুসলিম বৈষ্ণব-পদ রচয়িতা ‘কবীর’-এর নাম থেকে।” জানিয়েছেন, “চট্টোপাধ্যায় পদবিতে আমার বাবার কোনও হাত ছিলনা। চাটুজ্জের ছেলে চাটুজ্জে। আমার মায়ের পদবি ছিল ভট্টাচার্য, বিয়ের পরে চট্টোপাধ্যায় সেখানেও মায়ের কোনও হাত ছিলনা।” তাই শেষমেশ তিনি নিজেই হস্তক্ষেপ করেন। ধর্মে এবং পদবিতে।
লক্ষ্য করা যাবে, সাম্প্রতিক বিতর্ক অর্থাৎ ‘আরএসএস এর প্রতিনিধি’ সাংবাদিক উল্লেখ করে অশ্রাব্য গালিগালাজের জন্যেও তিনি একই ভঙ্গিতে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। ক্ষমা চেয়েছেন ফেসবুকেই! অর্থাৎ যে মিডিয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। ক্ষমা চাওয়ার পরে তিনি সদর্পে ঘোষণা করেছেন, আর কার কার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে তার একটা লিস্ট পাঠাতে। এখানেও সেই ডোন্ট কেয়ার মনোভাবাপন্ন সুমনের চেহারাই প্রতিফলিত হয়, যাঁকে তাঁর বাবা বলেছিলেন, “তোমার লাইফ নিয়ে তুমি যেটা করছ, সেটা অ্যাডভেঞ্চার নয়, ম্যাডভেঞ্চার।”
তাই একাধিক বিয়ে, আমেরিকার সাংবাদিকতা ছেড়ে কলকাতায় চলে আসা, নাস্তিক বলে ঘোষণা করেও ‘প্রফেট’-এর প্রতি মুগ্ধতা এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে রূপান্তরও ‘ম্যাডভেঞ্চার’ বৈকি!