গেরুয়া ধ্বজাধারীদের আইনি হুমকির তীব্র সমালোচনা করল সুপ্রিম কোর্ট। ১লা নভেম্বর ডাবরের বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সিনিয়র বিচারপতি ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড় এইসব স্বঘোষিত সমাজপতিদের কথায় কথায় ধমকি ও প্রতিরোধী কার্যকলাপকে ‘জন অসহিষ্ণুতা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
সম্প্রতি ফ্যাব ইন্ডিয়া, ডাবর সহ বেশ কিছু সংস্থাকে তাদের সম্প্রচারিত বিজ্ঞাপনের কারণে হুমকি দিয়ে চলেছে গেরুয়াধারী বিদ্বজ্জনেরা। তাদের হুমকি ও আক্রমণের ফলে সেইসব বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন এইসব সংস্থা। এইসব বিজ্ঞাপন প্রস্তুতকারকদের বিরুদ্ধে কখনো তোলা হচ্ছে হিন্দু ধর্মের অবমাননার অভিযোগ, তো কখনো আবার সংস্কৃতির অবক্ষয়ের আরোপ লাগিয়ে ফতোয়া জারি করা হচ্ছে।
অক্টোবরের শুরুতেই তীব্র মৌখিক আক্রমণের শিকার হয় ফ্যাব ইন্ডিয়া। বিখ্যাত এই গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক সংস্থা তাঁদের বিশেষকিছু কালেকশনের বিজ্ঞাপনে ট্যুইটারে ক্যাপশন হিসেবে লিখেছিল, “ভালোবাসা ও আলোর উৎসবের প্রাক্কালে ফ্যাব ইন্ডিয়ার জশন-এ -রিওয়াজ কালেকশন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছে”।
সাথে সাথে আপত্তি শুরু হয়। আপত্তি ওই ‘জশন-এ-রিওয়াজ’ শব্দটির জন্য।হিন্দুদের উৎসবে উর্দু শব্দ ব্যবহার অপমানজনক, এমন আরোপ করে বেশকিছু নীতিবাগীশ নেটিজেন তীব্র সমালোচনায় মুখর হন, ফ্যাব ইন্ডিয়ার প্রোডাক্টকে ন্যক্কারজনক ভাষায় অপমান করতে থাকেন। রাতারাতি চালু হয়ে যায় ভার্চুয়াল আন্দোলন #BoycottFabIndia. যার ফলে ফ্যাব ইন্ডিয়া তাদের বিজ্ঞাপন তুলে নেয়।
একইভাবে নীতিগুরুদের অভিযোগের শিকার হয় ডাবর সংস্থা। এবার সরাসরি প্রতিবাদমঞ্চে নামেন মধ্যপ্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং! বদলাচ্ছে বিজ্ঞাপনের ধরণ। উঠে আসছে সমাজের বিভিন্ন প্রান্তিক ছবি। শুধুই বিপনন নয়, একসময়ের ‘বিজ্ঞাপন’ শব্দটির ব্যাপক অর্থ নতুন রূপে প্রকাশ পাচ্ছে এইসকল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, সমাজের সচেতন এক শ্রেণীর অন্তত তাই মত। অনেকে তাই ডাবর সহ বিভিন্ন সংস্থার এই নতুন ধরনের বিজ্ঞাপনকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তেমনই বিপরীতে উঠছে সমালোচনার ঝড়।
ঠিক সেভাবেই ভেবেছিল ডাবর। এলজিবিটি-রাও স্বীকৃতি চান, তাদেরই কিছু ইচ্ছেপূরণের খুশিকে উজ্জ্বল রূপে প্রকাশ করেছিল ওই সংস্থা তাদের এক ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনে। দুই মহিলা সমকামী করবা চৌথ উপলক্ষে পরস্পরের মুখ দেখছেন, তাদের সমর্থনে পাশে দাঁড়িয়েছেন মা-ও। সৌন্দর্যের এই নতুন আবেদনে রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়েছেন মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরোত্তম মিশ্র। তিনি বলেন, “হিন্দু সংস্কৃতির একটি অনুষ্ঠানে এইভাবে লেসবিয়ানদের দেখানো উচিত হয়নি। আমি ডাবর সংস্থাকে এই বিজ্ঞাপন তুলে নিতে আর্জি জানাচ্ছি। তা নাহলে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেব”।
এই শীতল হুমকির পর স্বাভাবিক ভাবেই বিজ্ঞাপন তুলে নিতে বাধ্য হয় ডাবর, এবং লিখিতভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে জানায়–কারোর ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের উদ্দেশ্য আমাদের ছিলনা।
ওই একইভাবে অভিযোগে আক্রান্ত হয়েছেন ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় তাঁর বিতর্কিত মঙ্গলসূত্রের বিজ্ঞাপনের কারণে। অন্তর্বাস পরিহিতা নারীর গলায় মঙ্গলসূত্র দেখানো হিন্দু সংস্কৃতির অপমান (!) এই অভিযোগ ওঠায় তীব্র সমালোচনার শিকার হন জাতীয় পর্যায়ের খ্যাতিমান ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচী। তিনিও বিজ্ঞাপন তুলে নিতে বাধ্য হন এবং বলেন, “আমাদের বহুমুখী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মঙ্গলসূত্রের এই বিজ্ঞাপন আসলে নারী ক্ষমতায়নের প্রচার ছিল। আমরা ক্ষমাপ্রার্থী ..”
কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে এই ক্ষমতার আস্ফালন কাদের? কথায় কথায় আইনি হুমকি দিয়ে নীতি নির্ধারক সেজে বসছেন কারা? প্রশ্ন করছে শীর্ষ আদালত। গতকাল ডাবর প্রসঙ্গ টেনে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র বিচারপতি ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড় তাঁর বিবৃতিতে বলেন, “একটি সংস্থার বিজ্ঞাপনে এক সমপ্রেমী যুগলকে দেখানো হয়েছিল। তারপর জন অসহিষ্ণুতার কারণে সেই বিজ্ঞাপন তাঁদের প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সমাজে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব কতটা দৃঢ়ভাবে গেঁথে রয়েছে এবং মহিলাদের কীভাবে প্রতিদিন বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে”।
মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ও একাধিক ফতোয়া দাতার অভিযোগ, নাকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের বক্তব্য? জনগণ কোনটা গ্রহণ করবেন সে বিচার জনগণের ওপরই রইল।