‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ শব্দটির মানে নিয়ে বিস্তর কচকচি চলতেই পারে, তবে এর আন্তরিক অর্থটা অনেক আগেই বুঝেছিলেন খিদিরপুর মুন্সীগঞ্জের যৌনপল্লির বাসিন্দারা। এই পল্লির ফাইভ স্টার ক্লাব আয়োজিত দুর্গাপূজোর উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই মুসলিম ধর্মাবলম্বী! শুধু তাই নয়, দক্ষিণ কলকাতার এই আপাত নিষিদ্ধ পল্লির পূজোর সাথে জড়িয়ে ৭৮ বছরের ইতিহাস।
১৯৪০ সাল। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন দেশভাগের জিগির উঠেছে সেইসময়ে এই দেশভাগের প্রতিবাদ রূপেই দুর্গাপূজো আয়োজন করেছিলেন এই যৌনপল্লির বাসিন্দারা। সেই থেকে প্রতি বছর পূজোর ধারা আজও বহমান। শুরুর সেই সময়ে কমিটির কোনো নাম ছিলনা, ক্লাব ছিলনা — ছিল শুধুই দুই দেশে ভাগ না হওয়ার আর্জি। বর্তমানে এই পূজো পরিচালনা করে চলেছে ফাইভ স্টার ক্লাব। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যেটা তা হল, এই ক্লাবের মোট ৮৬ জন মেম্বারদের মধ্যে ৮৪ জনই মুসলিম। একসাথে দুর্গাপূজো তো বটেই, বিজয়ায় হিন্দু মুসলিম মহিলারা একসাথেই সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন।
এলাকাটি কলকাতা বন্দর বিধানসভার অধীনে। এই যৌনপল্লিতে পূজো দেখার ভিড় তো হয়না, তাই চাঁদাও জোটেনা খুব বেশি। ক্লাবের মেম্বাররা একরকম নিজেদের খরচেই পূজো করে আসছিলেন। কারণ, ছোটবেলা থেকেই তাঁরা দেখেছেন বাবা কাকারা বছর বছর পূজো করে আসছে। বর্তমানে এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিম, সেক্রেটারি বলবন্ত সিংহ, ক্যাশিয়ার মহম্মদ লতিফ। তাঁরাই উদ্যোক্তা। তবে গত দু’বছর মমতা ব্যানার্জীর সরকারের পক্ষ থেকে ৫০,০০০ টাকা পাচ্ছেন এই পূজো কমিটি। সেটাই পূজো চালানোয় বড় ভরসা।
প্রতিবার পূজোয় সারা কলকাতা যখন থিম সজ্জায় আলোকমালায় ঝলমল করতে থাকে, তখন খিদিরপুর বন্দর এই এলাকার এই টিমটিম আলোর ভেতর ত্রিনয়নে খুশির ঝলক মেখে মুসলিম সন্তানদের কাঁধে চড়েই মা দুর্গা আসেন। এবারও হয়েছিল তাই।
ধর্মীয় হিংসার ঘটনায় এপার-ওপার দুই দেশ যখন উত্তাল, কোরান রেখে অবমাননা, প্রতিমা ভেঙে পাল্টা প্রতিশোধ, পরিকল্পিত দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে সব জায়গায়–সেই সময় অনায়াসে এই সবকিছু থেকে দূরে থেকে নীরবেই আন্তরিক পূজো সেরে নির্দিষ্ট দিন বিসর্জন হল ‘মুসলিম’ আয়োজিত এই ফাইভস্টার ক্লাবের দুর্গা।
বিসর্জনের সময় মা দুর্গা যেন কানে কানে মুসলিম ভাইয়েদের বলে গেলেন — “আসছে বছর আবার হবে। আর কোথাও যাই বা না যাই, এখানে ঠিকই আসব আমি!”