আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস । প্রকৃতপক্ষে এই দিনটি বাংলাদেশের ভাষা-শহীদ দিবস। কিন্তু মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম ও আত্মবলিদানের যে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত সারা বিশ্বের কাছে তৈরি হয়, সেই কারণেই ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
একটি দেশের সাংস্কৃতিক বিপ্লব যখন তার জাতীয় চেতনার সাথে সম্পৃক্ত হয় তাকেই যথার্থ নবজাগরণ বা রেনেসাঁ বলা যায়। সেই অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে রেনেসাঁ-র পূর্ণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে বাংলাদেশের যে অর্জিত স্বাধীনতা, তার প্রাথমিক চেতনার বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
দেশভাগের স্মৃতি তখন ছিল টাটকা। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে তখন ভারত বিচ্ছিন্নতার ক্ষতস্থানে রক্ত শুকোয়নি। সেই সময়েই পাকিস্তানের প্রবক্তা মহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকা সফরকালে রেসকোর্সের ময়দান এবং কার্জন হলে বক্তৃতাসভায় অংশ নেন। বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি জোর দিয়েছিলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু!” সাথে সাথে একদল ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়। উল্লেখ্য, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই প্রতিবাদকারী ছাত্ররা ছিল বাঙালি। সেই থেকে সূত্রপাত।
জিন্নাহ ভীত হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রনেতা ভীত হয়ে পড়লে আগ্রাসন তীব্র হয়। ঠিক তাই হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৪৮ সালের মার্চ থেকে বাংলাভাষা আন্দোলনের সূচনা। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করতে হবে, “আমি বাংলায় গান গাই/ আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই” এই চেতনা যা পরে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করে তারই মূর্ত সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ‘৪৮ সাল থেকেই। তেমনই প্রতিবাদ দমনে সক্রিয় হয় রাষ্ট্রক্ষমতা। শেষপর্যন্ত ১৯৫২ সালে এই আন্দোলন চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নামেন প্রতিবাদীরা।
১৪৪ ধারা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বতন কলাভবনে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ চালায় ছাত্রছাত্রীরা। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করে পুলিশ। তাতেও ভাষা আন্দোলনকারীদের দমাতে ব্যর্থ হওয়ায় মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের দিক থেকে গুলি চালাতে শুরু করে। ওইদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৪ তরুণ রফিক, সালাম, আব্দুল জব্বার ও বরকত।
এই নৃশংস আক্রমণের ঘটনায় বিস্ফোরণে ফেটে পড়েন ঢাকার মানুষজন। পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলিত হয়। ঢাকার মিছিল আক্ষরিক অর্থেই জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শেষপর্যন্ত নতি স্বীকার করে জিন্নাহ সরকার। বাংলা ভাষাকেই পূর্বপাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে এই ভাষা আন্দোলনই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ’ গঠনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বাংলাভাষার আন্দোলনকে তাই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে সাংস্কৃতিক বিপ্লব আখ্যা দেওয়া যায়। কেন এটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছিল? সেটা অবশ্য ঘটেছিল অনেক পরে।
১৯৫৩ সাল থেকে প্রতিবছরই ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে ‘ভাষা শহীদ দিবস’ রূপেই পালিত হয়ে আসছিল। বাংলা ও বাঙালির আত্মবলিদানের শহীদস্তম্ভে মাল্যদান, প্রভাতফেরি খালিপায়ে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হত, এখনও সেটি বিদ্যমান। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও এই দিনটির সাথে একাত্মতা খুঁজে পান। বাংলা ভাষার শহীদ দিবস তো বটেই, বর্তমানে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৯৯ সালের আগে পর্যন্ত সারা বিশ্বের জন্য কোনো মাতৃভাষা দিবস ছিলনা।
সেইসময়েই প্রস্তাব ওঠে ভাষার জন্য বাংলাদেশের বৃহত্তর এই আন্দোলন ও বলিদানের দিনটিকেই আন্তর্জাতিক মান্যতা দেওয়া উচিত। ১৯৯৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেসকো-র অধিবেশনে ‘ভাষাশহীদ দিবস’ অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকেই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিশ্বের মঞ্চে বাংলা ভাষার এটিই নজিরবিহীন অর্জিত সম্মান এবং সকল দেশের মাতৃভাষাকেই সম্মান জ্ঞাপনের দিন এই ২১ ফেব্রুয়ারি।