লকডাউন– শব্দটা শুনলেই মধ্যবিত্তের মননে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। একাংশ হয়তো বলবেন, ঠিক এছাড়া কী উপায়! আরএক অংশ দ্বিধাসত্ত্বেও ‘না’-ই বলবেন। ধনী সম্প্রদায় এই শব্দটি মনেপ্রাণে না চাইলেও, লকডাউনে বিশেষ কিছু তারতম্য বোধ করেননা। তাঁদের কাছে বড়জোর এটা একরকমের ডেইলি রুটিন থেকে অবসরের মতো। আর নিম্নবিত্ত! রোজগেরে চাকুরিজীবি থেকে দিনমজুর প্রত্যেকের কাছেই ‘লকডাউন’ শব্দটাই একটা বিভীষিকা।বিগত ২ বছরে শব্দটার সাথে পরিচিত হয়ে গিয়েছেন প্রায় সকলেই। আজ করোনার তৃতীয় ঢেউ এসে মনে আবারো জিজ্ঞাসা তুলছে — লকডাউন হবে নাকি?
কেউ হয়তো ব্যক্তিগতভাবে আংশিক সমর্থন করলেও করতে পারেন, কিন্তু জনসাধারণের বৃহৎ অংশ মোটেও লকডাউন চাইছেননা আর। বিগত বছরের দিনগুলোর ক্ষতির হিসেব ধরলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায়।
প্রথম ঢেউয়ে সারা বিশ্বে যখন কোভিড ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা স্তব্ধ, সেইসময় দাঁড়িয়েও অক্সফোর্ডের বাঙালি বিজ্ঞানী সুনেত্রা গুপ্ত বলেছিলেন,”করোনার সাথে মোকাবিলায় লকডাউন কোনও কাজে আসবেনা।” সুনেত্রার পরিস্কার দাবি ছিল, “লকডাউন ধনীদের জন্য জরুরী ব্যবস্থা। অর্থাৎ যাঁদের হাতে দৈনন্দিন সরঞ্জাম মজুত, নিদেনপক্ষে তা যোগাড় করে নেওয়ার সামর্থ রয়েছে তাদের জন্য।”
লকডাউনের প্রবক্তা ব্রিটিশ বিজ্ঞানী নেল ফার্গুসন। যাঁর সাথে রীতিমতো টক্কর দিয়েছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী সুনেত্রা। এর প্রমাণ বিগত দুই বছরে আমরা পেয়েছি। দেখেছি কীভাবে রুজিরোজগারের অভাবে রিক্ত হয়েছেন ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ মানুষজন!
আজ যখন তৃতীয় ঢেউয়ে শিশুদের জন্য দেশবাসী অতিমাত্রায় চিন্তিত, ভ্যাক্সিনেশন অবশ্যই জরুরী। কিন্তু বহু আগে, সেই প্রথম সংকটের সময়ই সুনেত্রা গুপ্ত বলেছিলেন, “অল্পবয়সীদের শরীরের সঙ্গে প্রতিষেধক নয় ভাইরাসের সাথে সমঝোতা হওয়া দরকার। যত তাড়াতাড়ি শরীরে সঙ্গে ভাইরাসের পরিচয় ঘটবে তত দ্রুত সামলানো যাবে পরিস্থিতি। ঘরে বসে থেকে সেটা সম্ভব নয়।”
দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন যখন দেশে লকডাউন নিয়ে দ্বিধা সত্ত্বেও পরিকল্পনা চলছিল, তখন অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ জানিয়েছিলেন, “আমাদের উৎপাদননির্ভর শিল্প ৫০ শতাংশ শ্রমিক ও পরিষেবা ক্ষেত্র ৮০ শতাংশ শ্রমিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এঁরা মজুরি না পেলে সংসার চালাতে পারবেননা।” পাশাপাশি হিসেব করে দেখিয়েছিলেন, “এই শ্রমিকরা মজুরি না পেলে, জিডিপি কমে গিয়ে পরোক্ষে সেই প্রভাব দেশেরই অর্থনীতিতে পড়বে।”
এই দোদুল্যমান অবস্থায় দ্বিতীয়বার যখন লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সেইসময়ে বার্কলেসের একটি সমীক্ষার রিপোর্টে দেখা গিয়েছে লকডাউনের ফলে সারা দেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৯৪০ কোটি টাকা!
এরপরেও একটা সংশয় বিরুদ্ধ প্রশ্ন তোলে, আর্থিক ক্ষতির চেয়েও প্রাণরক্ষাই কি বড় নয়? হ্যাঁ, কিন্তু এই প্রশ্নটাকে উল্টে অপরপিঠে দেখুন, দেখবেন প্রশ্ন উঠছে– অধিকাংশ খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন রোজগার বন্ধ হলে তারা বাঁচবেন কীকরে?
এই প্রশ্নটা ইতিমধ্যেই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।