স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে আয়োজিত হয়েছে ‘বিপ্লবী ভারত গ্যালারি’-র প্রদর্শনী। ভিক্টোরিয়ার অভ্যন্তরে চারটি প্রেক্ষাগৃহ মিলিয়ে প্রায় ৪৫০০ স্কোয়্যারফিট জায়গা সেজে উঠেছে ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবীদের নিদর্শন ও ইতিহাস নিয়ে।
এই প্রদর্শনী দীর্ঘদিন ধরে চালানো হবে। আজ বুধবার দিল্লী থেকে ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর এই বক্তব্য ঘিরেই দানা বাঁধলো বিতর্ক। পাশাপাশি এই প্রদর্শনীতে ‘উপেক্ষিত সশস্ত্র সংগ্রামীদের’ বিষয়বস্তু নিয়েও অনেক ইতিহাসবিদ দ্বিমত পোষণ করছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে ভারতের সশস্ত্র সংগ্রামীদের নিয়ে আলোচনায় মনগড়া ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন, সেটাই শোরগোল তুলেছে বেশি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ ও প্রদর্শনীর বিষয়বস্তুতে যেভাবে ‘বিদেশি আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ছত্রপতি শিবাজি, রাণা প্রতাপ বা ১৮৫৭র বিদ্রোহীদের লড়াই সশস্ত্র বিপ্লবীদের প্রেরণা যুগিয়েছিল’ বলে উল্লিখিত হয়েছে তার বিরোধিতা করেছেন ইতিহাসবিদ সুগত বসু। তিনি বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রীকেও এক হাজার বছরের গোলামীর কথা বলতে শোনা গিয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশের থেকে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূরণ উপলক্ষ্যেও যদি এই তত্ত্ব প্রচার করা হয়, তবে এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু নেই।”
পাশাপাশি ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিত দে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সোজাসুজি ‘ইতিহাসের অপব্যাখ্যা’ বলেই উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক দে ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝান, “শিবাজির কথা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে বিপ্লবীদের একাংশকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ঠিকই, কিন্তু শিবাজি বিদেশিদের বিরুদ্ধে লড়েননি।” অমিতবাবু স্মরণ করান, “ঔরঙ্গজেবের মা-ও রাজপুত ছিলেন।মোঘলদের আর কোনও দেশ ছিলনা, ওঁরা বিদেশি নন। তেমনই উল্টোদিকে শিবাজির সাথেও রাজপুত ও দাক্ষিণাত্যের হিন্দু রাজাদেরও অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত ছিল।”
ইতিহাসবিদ সুগত বসু তাঁর বক্তব্যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে অত্যন্ত সময়োপযোগী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, “সুভাষচন্দ্র তাঁর দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল বইয়ে বলছেন, মোঘল বাদশাদের আমলে মুসলিম, হিন্দু মিলেই ভারত শাসন করা হত। সুভাষচন্দ্রও মোঘলদের বিদেশি বলে দেখতেননা।”
যে সাভারকরকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী তথা বিজেপি-আরএসএস উচ্ছসিত, এদিনও বারংবার প্রধানমন্ত্রী যাঁর নাম উল্লেখ করেছেন, ইতিহাসবিদ তনিকা সরকারের মতে, “সাভারকর প্রথমজীবনে সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িত থাকলেও সেলুলার জেল থেকে বেরিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে টুঁ শব্দটিও করেননি। তাছাড়া ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।”
কংগ্রেসিরা ইতিহাসের অনেক পাঠ্যবইয়ে সশস্ত্র বিপ্লবীদের কিছুটা উপেক্ষার নজরে আনলেও সেটা নিয়ে তৎকালীন ঐতিহাসিকদের মধ্যে এনিয়ে বিরোধিতাও ছিল। কংগ্রেসী হয়েও রমেশচন্দ্র মজুমদার এই উপেক্ষার বিরোধিতা করেছিলেন। জানান অধ্যাপক অমিত দে।
তবে তনিকা সরকারের মতো প্রত্যেকেই একটি বিষয়ে একমত, “সাভারকরের প্রথমজীবনের অংশগ্রহণটুকু বাদ দিলে আজকের হিন্দু মহাসভা কিংবা আরএসএস-এর প্রণেতাদের কেউই ব্রিটিশদের বিরোধিতা তো দূর, পরোক্ষভাবেও স্বাধীনতা আন্দোলনের নামগন্ধও করেননি, সেকারনে ব্রিটিশদের বিরাগভাজনও তাঁরা হননি। তাই সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে হঠাৎ নরেন্দ্র মোদীরা উদ্বেল হয়ে উঠলে তাও একপ্রকার আত্মসাতের চেষ্টাই বলতে হবে।”
ইতিহাসবিদদের এই ব্যাখ্যাগুলি সাম্প্রতিক রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রেও সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, যেখানে ইন্ধনটা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই আজ যুগিয়ে দিয়েছেন।