গতকাল থেকেই কবীর সুমন ও শ্রীজাত সংবাদের শিরোনামে। চলছে তুমুল বিতর্ক। বিতর্কের সূত্রপাত একটি অডিক্লিপ নিয়ে। যেখানে কবীর সুমনের কন্ঠস্বরে অনর্গল খিস্তি বর্ষিত হচ্ছে (অডিওটি সংবাদ মাধ্যম দ্বারা যাচাইকৃত নয়)। আর এই কন্ঠস্বরের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন কবি শ্রীজাত। রাত আটটার দিকে এই বিতর্কে আরো একটি নাম যুক্ত হয়, তৃণমূলের রাজ্যসম্পাদক কুনাল ঘোষ। যে তিনটি নাম নেওয়া হল, এঁরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক মহলের চেনা ব্যক্তিত্ব। গোটা ব্যাপারটায় নেটিজেন থেকে সাংবাদিক মহল বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও ধন্দ কাটছেনা একটি বিষয়ে — কে কার উদ্দেশ্যে কেন প্রতিবাদ করলেন! আসলে ব্যাপারটা কী?
উল্লিখিত অডিও ক্লিপটিতে শোনা যায়, কোনো একটি নিউজ চ্যানেল থেকে এক ব্যক্তিকে ফোন করে পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথেই ‘আরএসএস এর চ্যানেল’ বলে উদ্ধৃত করে সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে চলেছেন ওই ব্যক্তি (কবীর সুমনের কন্ঠস্বর)। আরএসএসের নাম করে ‘শূয়োরের ***’ থেকে শুরু করে মা-বাপ তুলে এমন ভাষা বর্ষিত হয়েছে যা উচ্চারণযোগ্য নয়। যথারীতি অডিও ক্লিপটি ভাইরাল হয়, এবং বিভিন্ন মহল থেকে উষ্মার আবহাওয়া তৈরি হতেই একটি ফেসবুক পোস্টে (পাবলিক পোস্ট নয়) কবীর সুমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন “যা করেছি বেশ করেছি। দরকার হলে আবার করব। ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপে আমি স্বাভাবিকভাবেই আক্রান্ত। তাতে আমার কিছু যায় আসেনা।” এরপরেই ঘটনাটা আরেক দিকে মোড় নেয় যখন কবি-গীতিকার শ্রীজাত এই আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
সাংবাদিকদের পক্ষ অবলম্বন করে শ্রীজাত এই আচরণের তীব্র নিন্দা করে ‘বিরোধীদের বলতে দাও’ শীর্ষক পোস্টে লিখেছেন, “শিল্প আর শিল্পীর স্বাধীনতার আড়ালে যে যা খুশী করতে পারেননা। কাউকে অপমান করার অধিকার আপনাকে শিল্প দেয়নি।” এইখানে একটু থেমে একটা প্রশ্ন রাখা যায়, আরএসএস ও বিজেপির সংগঠকদের কি মনে পড়ছে ‘ত্রিশূলে’র কথা! যখন তাঁরা এই শ্রীজাতর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছিলেন? না পড়াই স্বাভাবিক। তবে একজন শিল্পীর কোনও দল হয়না। উল্লেখ্য, এই দীর্ঘ পোস্টের বক্তব্যের মর্মোদ্ধার করলে বোঝা যায়, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপমানজনক ভাষার যথোচিত প্রতিবাদই তিনি করেছেন। ব্যক্তি সুমনের বিরুদ্ধে বা বিশেষ কোনও সংগঠনের পক্ষ নিয়ে এই প্রতিবাদ নয়। শ্রীজাত আরো বলেছেন, “কেউ যদি আমার বিরোধীও হয়, তাঁর প্রস্তাবে আমি যদি অসম্মতও হই, তবে তা প্রত্যাখ্যানেরও দস্তুর আছে। এমনকি হেডলাইন হয়ে ওঠার খিদে থেকেও তাঁকে অসাংবিধানিক ভাষায় গরগরে আক্রমণ করার অধিকার আমার নেই।”
সঠিক কথা। কিন্তু একটি প্রশ্ন এবার শ্রীজাতর দিকে ঘুরে যায় — উল্লিখিত ওই অডিওক্লিপের ভাষা অমার্জনীয়। তা RSS হোক বা যাদের উদ্দেশ্যেই করা হোক, তা অনুচিত কাজ। তবে এই নিন্দনীয় কন্ঠস্বরটি কি শুধুই হেডলাইন হয়ে ওঠার জন্য খিস্তি বর্ষণ করেছেন? সুমনের পোস্টে বোধহয় এর উত্তর আছে। কবীর সুমন লিখেছেন, “আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন, কিছুর পক্ষে যুক্তি দিতে যেওনা। তোমার বন্ধুদের তা দরকার পড়বেনা, তোমার শত্রুরা তা বিশ্বাস করবেনা। সুরসম্রাজ্ঞীর (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের) অপমানের বিরুদ্ধে যে সাংবাদিক বৈঠক হয়েছিল সেখানে কোন চ্যানেলের কোন সাংবাদিক কি বলেছিল তা আমি ভুলিনি।”
তাহলে এটা স্পষ্ট, এক প্রবল জেদি মনোভাব থেকে উদ্দেশ্যমূলক এই আক্রমণ! অর্থাৎ এই আচরণ একপ্রকার জমাট অসন্তোষের অবস্থান বিক্ষোভ। আসলে আক্রান্ত হয়েছে ‘পক্ষপাতদুষ্ট সাংবাদিকতা’। তবে যে পদ্ধতিতে যে ভাষায় সেটি হয়েছে তা অনুচিত মনে করছেন অনেকেই। আপামর বঙ্গ-নেটিজেনরা আরো চমকে গেছেন কুনাল ঘোষের ট্যুইট দেখে।
গোটা ঘটনায় নিরপেক্ষ এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে কুনাল ঘোষ ট্যুহটে লেখেন, “যে অডিওটি ঘুরছে সেটি যদি কবীর সুমনেরই হয়, তাহলে তা অতি আপত্তিকর এবং তীব্র প্রতিবাদযোগ্য। এর জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত, না চাইলে ব্যবস্থা হওয়া উচিত।”
লক্ষণীয়, ‘চোর, টাকা ফেরত দে’ বলে দিনরাত সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসার আক্রমণ যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে, তাঁর এই ঠান্ডা মাথার বক্তব্যকে অনেকেই প্রশংসার নজরে দেখছেন।
এখন গোটা ঘটনায় RSS বা গেরুয়া শিবিরের ভাবমূর্তিই কি শেষমেশ লজ্জার মুখে পড়ল? সেটাই অনেকে গালে হাত দিয়ে ভাবছেন।